অনলাইন ডেস্ক:
গুলি করে হত্যা করা হয়েছে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে। শুক্রবার এক নির্বাচনী প্রচারণায় তাকে টার্গেট করে গুলি চালায় দেশটির সাবেক এক নৌসেনা। সেই গুলি লাগে ৬৭ বছর বয়স্ক আবের গলায় ও বুকে। আহত আবেকে বাঁচাতে দীর্ঘ চেষ্টা ও অস্ত্রোপচার চলে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় সরকারের তরফ থেকে। শিনজো আবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিবিসির খবরে জানানো হয়েছে, জাপানের নারা শহরে প্রচারণা চালাতে গিয়েছিলেন আবে। তিনি যখন বক্তৃতা দিতে উঠেন তখন পেছন থেকে তাকে গুলি করা হয়। তিনি বক্তৃতার মাঝখানেই লুটিয়ে পড়েন। ৪১ বছর বয়সী হামলাকারীকে আটক করেছে পুলিশ। শিনজো আবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ২০১২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত।
র আগে ২০০৬ সালে একবছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। শিনজো আবে জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত সমস্যার উল্লেখ করে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে জানা যায়, তিনি আলসারেটিভ কোলাইটিজে ভুগছেন। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর উত্তরাধিকার হিসেবে ক্ষমতায় আসেন নতুন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। প্রতিবেশি দেশ ভারতে আবের মৃত্যুতে একদিনের শোক পালিত হবে।
তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পূর্বেই টোকিওর সাবেক গভর্নর ইয়োচি মাসুজোই টুইটে বলেছিলেন, শিনজো আবে ‘কার্ডিওপালমোনারি অ্যারেস্ট’ অবস্থায় আছেন। কোনো মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করার পূর্বের মুহূর্তকে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। জাপানি গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, একটি নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নারা শহরে বক্তব্য রাখছিলেন। আগামী রোববার সেখানে উচ্চ কক্ষের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তিনি।
স্থানীয় সময় আজ সকাল সাড়ে এগারটার দিকে তিনি ‘কলাপসড’ করেন। এর আগে সেখানকার লোকজন দুটি গুলির শব্দ শুনতে পান। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়েছে, তার ভিতর জীবনের কোনো স্পন্দন নেই। তাকে নেয়া হয়েছে কাশিহারা শহরে নারা মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে।
এ ঘটনায় নারা শহর থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ৪১ বছর বয়সী ইয়ামাগামি টেটসুইয়া নামে এক ব্যক্তিকে। তারা একটি অস্ত্রও উদ্ধার করেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এনএইচকের একজন রিপোর্টার। তিনি জানান, শিনজো আবের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
আবে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে তার বড় প্রভাব রয়েছে। এই দলের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ আবের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিনজো আবে ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে তিনি প্রথবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১২ সালে তিনি আবারো প্রধানমন্ত্রী হন। আবে ধনাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া তার এক দাদা জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
আবের উপরে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও। তিনি বলেন, এটা এক জঘন্য অপরাধ। নির্বাচনী প্রচারণার সময়টাতে এ ঘটনা ঘটেছে। এই নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের ভিত্তি। এমন কর্মকা- মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনার যথাযোগ্য দৃঢ়তার সঙ্গে আমি নিন্দা জানাই। যেকোনে পরিস্থিতি মোকাবিলর জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত সরকার। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিশ্ব নেতারাও। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রাহম ইমানুয়েল বলেন, শিনজো আবে জাপানের একজন অসাধারণ নেতা । তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অটল একজন মিত্র ছিলেন। তার পরিবার ও জাপানের জনগণের মঙ্গল কামনা করছে মার্কিন জনগণ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ টুইটে লিখেছেন, জাপান থেকে হতাশাজনক খবর- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে’কে গুলি করা হয়েছে। এ সময়ে তার পরিবার ও জাপানের জনগণের জন্য আমাদের প্রার্থনা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেছেন, জি২০ ভুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের তরফে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহানুভূতি জানানো হয়েছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন বলেন, আমার মনে হয় এ খবরে আমার মতো সবাই বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছেন। তাইওয়ান ও জাপান উভয়েই আইনের শাসন দিয়ে পরিচালিত দুটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমার সরকারের পক্ষে ভয়াবহ সহিংসতা ও বেআইনি কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা জানাই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শুধু আমারই একজন ভাল বন্ধু নন, একই সঙ্গে তাইওয়ানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাইওয়ানকে তিনি বহু বছর ধরে সমর্থন দিয়ে আসছেন।
‘প্রিয় বন্ধু’ শিনজো আবেকে হারিয়ে ‘শোকার্ত’ বার্তা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াণে ভারতে শনিবার এক দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি। শিনজোর মৃত্যুর পর টুইটারে এ কথা ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এতে তিনি বলেন, আমার প্রিয় বন্ধুর প্রয়াণে মর্মামত। দুঃখপ্রকাশের ভাষা নেই। বিশ্বের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। অসামান্য নেতা উনি। অসাধারণ প্রশাসক ছিলেন। জাপানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বহু বছর ধরে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তার পর থেকে সেই বন্ধুত্ব বজায় ছিল। অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি আমার উপর গভীর ছাপ ফেলেছে। মোদি আরও বলেন, আমার সাম্প্রতিক জাপান সফরেও তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন। তার পরিবার ও জাপানের মানুষের প্রতি সমবেদনা। জাপানের সঙ্গে শোকস্তব্ধ গোটা ভারত। এই কঠিন সময়ে জাপানের ভাইবোনদের পাশে রয়েছি।
উল্লেখ্য, জাপানে বন্দুক হামলা খুবই বিরল ঘটনা। কারণ, সেখানে অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ। জানা গেছে হামলাকারী নিজেই বন্দুকটি বানিয়েছিলেন। এছাড়া জাপানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যা করার ঘটনাও খুব একটা দেখা যায় না। ২০০৭ সালে নাগাসাকি শহরের মেয়র ইচো ইতোকে গুলি করে হত্যা করেছিল গ্যাংস্টাররা। ১৯৬০ সালে জাপানের সোশালিস্ট পার্টির প্রধানকে বক্তব্য দেবার সময় গুলি করে হত্যা করে ডানপন্থীরা।